নিচে তথ্যমূলক রচনার তিনটি শ্রেণি দেখানো হলো। কোন শ্রেণির তথ্যমূলক রচনার জন্য কীভাবে তথ্য সংগ্রহ করা যায়, তা তৃতীয় কলামে লেখো। লেখার পরে সহপাঠীর সঙ্গে আলোচনা করো এবং প্রয়োজনে সংশোধন করো।
তথ্যমূলক রচনার শ্রেণি | রচনার বৈশিষ্ট্য | কীভাবে তথ্য সংগ্রহ করা যায় |
---|---|---|
লাইব্রেরি-ভিত্তিক | লাইব্রেরিতে সঞ্চিত তথ্যের উপর ভিত্তি করে যেসব তথ্যমূলক রচনা লেখা হয় | |
পর্যবেক্ষণ-ভিত্তিক | সংগৃহীত তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে যেসব তথ্যমূলক রচনা লেখা হয়। | |
অভিজ্ঞতা-ভিত্তিক | নিজের অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে যেসব তথ্যমূলক রচনা লেখা হয়। |
আবু জাফর শামসুদ্দীন (১৯১১-১৯৮৮) একজন বিশিষ্ট সাংবাদিক ও সাহিত্যিক। তাঁর বিখ্যাত সাহিত্যকর্মের মধ্যে আছে 'ভাওয়াল গড়ের উপাখ্যান', 'পদ্মা মেঘনা যমুনা', 'রাজেন ঠাকুরের তীর্থযাত্রা' ইত্যাদি। নিচে আবু জাফর শামসুদ্দীনের লেখা একটি অভিজ্ঞতা-ভিত্তিক তথ্যমূলক রচনা দেওয়া হলো। রচনাটি 'আত্মস্মৃতি' বইয়ের অংশবিশেষ।
রচনাটি নীরবে পড়ো এবং এই লেখার মধ্যে লেখকের যে দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত হয়েছে তা খেয়াল করো।
আবু জাফর শামসুদ্দীন
আমার গ্রাম আমাকে আজীবন আকর্ষণ করেছে। বাংলাদেশ চিরহরিতের দেশ। তবু মনে হয়, আমার গ্রামের গাছপালা লতাপাতার মধ্যে কোথায় যেন আলাদা বৈশিষ্ট্য আছে।
ভাওয়াল পরগনায় অবস্থিত আমাদের গ্রামটি বর্ষাকালে দুভাগে বিভক্ত হয়ে যায়, পশ্চিম ভাগটি হয়ে যায় একটি বিচ্ছিন্ন ছোটো দ্বীপ। পশ্চিম অংশেই আমাদের ভিটেবাড়ি। গ্রামের পশ্চিমে বিশাল মাঠ। বর্ষায় বিরাট বেলাই বিলের সঙ্গে মিশে যায়। বেলাই বিল প্রকৃতপক্ষে একটি মস্ত বড়ো হাওড়-শীতকালে বোরো ধান হয়।
মাঠের সর্বত্র বৈশাখ মাসে কয়েক বছর আগেও কালা আমন, ধলা আমন, খামার বাজাল, কার্তিক শাইল প্রভৃতি ধান ছিটিয়ে বোনা হতো। পানি বৃদ্ধি পায়। ছিটিয়ে বোনা ধানগাছও লম্বা হয়। আষাঢ় মাসে বন্যার জলের সঙ্গে প্রবেশ করে শৈল, গজাল, বোয়াল, রুই, কাতল প্রভৃতি মাছ। কোচ, জুইতা প্রভৃতি অস্ত্র হাতে বেরিয়ে পড়ে গ্রামের মানুষ। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। মাঝে মাঝে রোদের ঝিলিক। কোন্দা এবং ডিঙি নৌকায় মাঠ ছেয়ে যায়। কাঁচা ধানের সবুজ শিষ নাড়িয়ে মাছ দৌড়োয়। কোচ, জুইতার ঘাইয়ে বিদ্ধ করে শিকারি।
ভাওয়াল পরগনার বর্ষাকালটা সত্য সত্যই চমৎকার। প্লাবিত মাঠের মধ্যে মধ্যে ছোটো ছোটো দ্বীপসদৃশ পরস্পর বিচ্ছিন্ন গ্রাম। মাইলের পর মাইল সবুজ খানের শিষ। মধ্যে মধ্যে আম, জাম, কাঁঠাল গাছঘেরা চিরহরিৎ পল্লি। পশ্চিমের হরিৎ মাঠ আমাকে মুগ্ধ করত। কেবলই মনে হতো, ঐ সবুজ মাঠটা যদি পাড়ি দিতে পারতাম। না জানি কী রহস্য লুকিয়ে আছে ওপারের ভাসমান গ্রামগুলোতে। বেলাই বিলের ওপর দিয়ে শীতে শীর্ণ বালু নদী প্রবহমান। তার পশ্চিম তীরে প্রতি শনি ও মঙ্গলবারে পুবাইলের হাট বসে। আমাদের গ্রাম হতে ছ-সাত মাইলের পথ। বর্ষায় নদী ও বেলাই একাকার হয়ে যায়। ভাওয়াল পরগনার নানা স্থান হতে তরিতরকারি, কাঁঠাল, আনারস, পেয়ারা, পাট, খান প্রভৃতি বোঝাই ছোটো বড়ো শত শত নৌকো বেলা ওঠার আগেই এসে উপস্থিত হয় পুবাইলের ঘাটে। ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ হতে যায় বড়ো বড়ো কঞ্জুরার নৌকো। নৌকোয় নৌকোয় কেনাবেচা। সে এক এলাহি কান্ড। আমার গ্রামের ফড়ে বেপারিরা সন্ধ্যারাত্রেই নৌকো বোঝাই করত। কেনাবেচা শেষ করে গ্রামে ফিরে আসত অনেক রাত্রে। আমার মনে হতো সার্থক জীবন ঐ হাটুরেদের।
ছইহীন ডিঙি নৌকোয় চড়ে পুবাইলের হাটে যাওয়ার বায়না ধরেছি। বাবা ঐ হাটে ক্বচিৎ-কদাচিৎ যেতেন। অন্যদের সঙ্গে যাওয়ার অনুমতি দিতেন না। বেলাইতে নৌকোডুবি হলে রক্ষা নেই। বেলাই সম্বন্ধে নানা উপকথা প্রচলিত ছিল। আমার দাদি বলতেন, এককালে নাকি বেলাই এবং শীতলক্ষ্যা একাকার ছিল। বাইরা গ্রাম হতে পলাশ পর্যন্ত প্রায় ৮/১০ মাইল ছিল খেয়া নৌকোর পাড়ি। রাজা ছিলেন খাটচা ডোশকা নামক জনৈক আদিবাসী। ঝড়ঝঞ্জা বিক্ষুব্ধ বেলাই নাকি রাজপুত্র, পুত্রবধূ এবং নাতি-নাতনি বোঝাই পানসি নৌকো গ্রাস করেছিল। শোকার্ত রাজার মনে প্রতিশোধস্পৃহা জাগে। তিনি শপথ করলেন, ডাইনি বেলাইর বুকে কাগা-বগা (কাক ও বক) চরবে, মাছ খাবে। তিনি বেলাইর পানি নিষ্কাশনের জন্য অসংখ্য খাল কাটান। কার্তিক-অগ্রহায়ণ মাসে এসব খাল দিয়ে বেলাইর পানি শীতলক্ষ্যায় নেমে যায়। শীতে সত্য সত্যই বেলাইর বুকে কাক-বকেরা হেঁটে হেঁটে মাছ খায়। সারস, সরাইল, পানকৌড়ি, ছেরছেরি পিপি, কোড়া প্রভৃতি নানা পাখি চড়ে বেড়ায়।
আমাদের গ্রামের নিচে একটি বড়ো বিল। আমার বাল্যকালে এই বিলেও একবার বিশাল আকৃতির বড়ো বড়ো পাখির পাঁচ সাতশোর একটি ঝাঁক নেমেছিল। ওরা ঘণ্টা দুঘন্টার মধ্যে বিলের বড়ো বড়ো মাছগুলো নিঃশেষে খেয়ে উড়ে গেল। দাদির মুখে শুত এ লোককাহিনিটি আমার মনে রোমাঞ্চ সৃষ্টি করত। বেলাইর উত্তর প্রান্তে রাজাবাড়ি গ্রাম। ভাবতাম ঐ রাজাবাড়িতেই হয়তো ছিল সুদূর অতীতের সেই মহাপ্রতাপশালী রাজা খাটচা তোশকার রাজধানী।
বেলাই পথে আমার পুবাইলের হাটে যাওয়া হয় আরো অনেক পরে। তখন আমার বয়স দশ-বারো এবং বাবা আমাকে বিলে বন্যার জলে সাঁতার শিখিয়ে ফেলেছেন। ভিটেবাড়ির নিচেই ঢালুতে পাটক্ষেত। আষাঢ়ে পাট কাটা হয়। শ্রাবণে অথৈ পানি। ঐ পানিতেই আমি আর আমার ছোটো দুভাই সাঁতার শিখেছিলাম। গোসলের আগে বাবা ঘণ্টা দুঘন্টা মসজিদের ঠান্ডা মেঝেয় অথবা বাংলা ঘরের তক্তপোশে ঘুমোতেন। ঐ সময়টায় আমি ছিলাম ফ্রি। পাড়ার ডানপিটে ছেলেদের সঙ্গে সাঁতার কাটতে বিলে নামতাম। ঘণ্টা দুঘন্টা ঝাঁপুড়ি খেলা চলত। মনে পড়ে একদিন ধরা পড়েছিলাম। সময় ব্যাপারে হুঁশ ছিল না। তখন প্রায় একটা বাজে। ঘুম হতে জেগে আমাকে না পেয়ে বাবা কফির লাঠি হাতে খুঁজতে বের হন। বাড়ির দক্ষিণ-পুবের এক বিলে আমাকে পাওয়া গেল। তাকে বিলের যে পাড়ে দেখা গেল আমি সে পাড়ে উঠলাম না। অন্য পাড় দিয়ে উঠে এক দৌড়ে বাড়ি পৌঁছে দাদির আশ্রয় নিলাম।
দাদির বয়স তখন একশো কিন্তু তখনও তিনি বেশ শক্ত-সমর্থ। মেরুদন্ড ঠিক। বাবা তাঁকে আম্মা সাব ডাকতেন। মায়ের কথার পৃষ্ঠে কথা তিনি কখনো বলতেন না। বাবা ছিলেন দাদির একমাত্র পুত্রসন্তান। তাঁর নয় বছরের ছোটো ছিলেন আমার ফুপু-ব্যাস এই দুজন। হাটবাজারে এবং ঢাকা যাওয়ার সময়, বাবা দাদিকে জিজ্ঞাসা করতেন, আম্মা সাব আপনার জন্য কী আনব? দাদির ফরমাশ ছিল এগুলো: পান, মজালো সুপারি, এলাচি, দারুচিনি, গুয়ামৌরি, যষ্টিমধু, মগাই খয়ের, মতিহারি সাদাপাতা, গুড়, কলা, খিরসা প্রভৃতি। দাদি দুধ-দই ভালোবাসতেন। শিং, মাগুর, শৈল, গজাল, টাকি, বোয়াল, ইত্যাদি মাছ খেতেন না। কবুতর এবং মোরগ ব্যতীত অন্য কোনো প্রাণীর গোশতও খেতেন না তিনি।
পিতামহ ১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকায় বিদ্যাচর্চায় লিপ্ত ছিলেন। ১৮৫৭ সালের ফৌজি বিদ্রোহে ঢাকার দেশি সিপাইরাও যোগ দিয়েছিল। বিদ্রোহ দমনকে উপলক্ষ করে ঢাকা শহরে ব্যাপক গণহত্যা শুরু হয়। শুনেছি লালবাগ কেল্লা এবং তৎসন্নিহিত এলাকা ঘেরাও করে তোপ দাগা হয়। এর ফলে নাকি প্রায় পাঁচ হাজার লোক মারা যায়। মৌলবি মুনশিরা ছিলেন ইংরেজের বিশেষ লক্ষ্য। ওদের পেলেই ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলানো হতো। আন্ডাঘরের ময়দানে (বাহাদুর শাহ পার্ক) গাছগুলোতে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল অসংখ্য মানুষ। দাদা ঐ সময়ে প্রাণভয়ে ঢাকা ত্যাগ করেন। ঢাকা ছাড়ার পর তিনি মসজিদকে কেন্দ্র করে সংগ্রাম এবং পার্শ্ববর্তী গ্রামসমূহের বালক-বালিকাদের দিনি এলেম শিক্ষাদানে নিযুক্ত হন।
১৮৫৯-৬০ সালের দিকে মওলানা কেরামত আলী জৌনপুরী বেশ কিছুকাল আমাদের বাড়িটিকে তাঁর আস্তানা করেন। দাদা তাঁর শিষ্য হন। দুজনে মিলে আমাদের অঞ্চলে ইসলাম প্রচার করেন। বিদ্যাশিক্ষা দানের বিনিময়ে দাদা কোনো পারিশ্রমিক গ্রহণ করতেন না। বাবাও ঐ ঐতিহ্য রক্ষা করেছিলেন। আমার বাল্যকালে বহু ছাত্রছাত্রী তাঁর কাছে পড়তে আসত। বাবার কাছে শুনেছি, দাদার ব্যক্তিগত লাইব্রেরিতে নাকি তিনশো কেতাব ছিল। তাঁর মধ্যে বেশ কিছুসংখ্যক হস্তাক্ষরে লিখিত গ্রন্থও ছিল। দু-চারটি আমি নিজেও দেখেছি। বাবার ১৭ বছর বয়সে দাদার মৃত্যু হয়। আত্মীয়স্বজনরা বহু কেতাব নিয়ে যায়। আমার বাল্যকালেও ৭০টি কেতাব ছিল। তার মধ্যে একটি ছিল আরবি অক্ষরে লিখিত বাংলা কেতাব। ১৯১৯ সালে ১২ ঘণ্টাব্যাপী ভয়াবহ ঝড়ে টিনের চাল উড়িয়ে নিয়ে যায়। আমরা মসজিদে আশ্রয় গ্রহণ করি। সারারাত ব্যাপী ঝড়বৃষ্টিতে পিতামহের স্মৃতিবিজড়িত কেতাবগুলো প্রায় সবই নষ্ট হয়ে যায়। উর্দু 'কাসাসুল আম্বিয়া' গ্রন্থটি পিতামহের লাইব্রেরির একমাত্র নিদর্শনরূপে এখন আমার কাছে আছে।
১৯১৯-২১ সালের কংগ্রেস খেলাফত আন্দোলনের সময়ে আমাদের গ্রামের উত্তর দিকের এক বড়ো চত্বরে এক বিশাল জনসভা হয়। বাবা সেই স্বদেশি জনসভায় সভাপতিত্ব করেছিলেন। সভায় জনৈক পাগড়িধারী মুসলিম বক্তার মুখে আমি সর্বপ্রথম জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের বিষয় এবং ব্রিটিশ ব্যুরোক্রেসি শব্দ দুটি শুনি। মনে হয়, উক্ত বক্তণ দেওবন্দি আলেম ছিলেন। সেকালে আমাদের অঞ্চলে বহু যুবক পড়াশোনা করতে দেওবন্দ যেত। মহাত্মা গান্ধী এবং আলী ভাইদের নামে জয়ধধ্বনি শুনেছিলাম সেদিনই প্রথম। বন্দে মাতরম এবং আল্লাহ আকবর দুই-ই ছিল সভার স্লোগান। সভাশেষে স্থানীয় কংগ্রেস-কাম-খেলাফত কমিটি গঠিত হয়। বাবা কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন। মনে পড়ে, তিনি বাড়িতে চরকা নিয়ে আসেন। দাদি কোম্পানির আমলের মানুষ- সুতো কাটতে জানতেন। হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে গ্রামের প্রায় সকলের বাড়িতে চরকা বসল। দাদি অনেককে সুতো কাটতে শিখিয়েছিলেন। ঘরে ঘরে মুষ্টির ঘাট। প্রতি শুক্রবারে মসজিদে মুষ্টির চাল জমা হতো। সে চাল পৌঁছে দেয়া হতো কেন্দ্রীয় কংগ্রেস খেলাফত অফিসে।
বাবার নিত্যকার পোশাক ছিল সাদা পাঞ্জাবি, সাদা তহবন, সাদা টুপি, চটি জুতো এবং ছাতা। তৎকালে হিন্দু- মুসলিম নির্বিশেষে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির লোকদের অধিকাংশ চটি জুতো ব্যবহার করত। হিন্দু মহিলারা জুতো পরত না। মুসলিম মহিলারাও সাধারণত চটি জুতা পরত না-কারও কারও প্যাটেন্ট লেদারের ফুলতোলা রঙিন পাম্পশুও ছিল। হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সাধারণ চাবি পরিবারের মহিলাদের একমাত্র পরিচ্ছদ ছিল পেঁচিয়ে পরা একটি শাড়ি। সারাদিন নগ্নপদে কাজ করার পর রাত্রে পা ধুয়ে কেউ কেউ খড়ম পরত। অনেকের তাও ছিল না। প্রচন্ড শীত পড়লে চাষি পুরুষেরা তাল গাছের ডালার গোড়ার ঘোল মাপ অনুযায়ী কেটে তার মধ্যে দড়ির বেড় দিয়ে এক ধরনের স্যান্ডেল তৈরি করে নিত। এগুলোকে বলা হতো 'পাওটি'। অধিকাংশ চাষি পরিবারে শৌচকার্য ও হাত ধোয়ার জন্য মাটির লোটা এবং ভাত খাওয়ার জন্য মাটির সানকি ব্যবহৃত হতো। কলসিও ছিল মাটির। শয্যা ছিল বাঁশ-বেতির দরমা। শীতকালে দরমার নিচে খড়কুটো এবং দরমার ওপরে কাঁথা বিছানো হতো। আমাদের বাড়িতে কেরোসিনের কুপি জ্বলত। ঝড়-বাদলের রাত্রির জন্য একটি ল্যান্টার্নও ছিল। অধিকাংশ লোকের বাড়িতে বুহুইনা গাছের বিচি হতে সংগৃহীত তেলের প্রদীপ জ্বলত। এই প্রদীপের নাম ছিল 'মুছি'।
আমাদের গ্রামে আট দশটি পরিবারের একটি ব্রাহ্মণপাড়া ছিল। একটি পরিবারের উপাধি ছিল চক্রবর্তী। বাকি সবাই ছিল ভট্টাচার্য ব্রাহ্মণ এবং একই গোত্রভুক্ত। অবশিষ্ট হিন্দুদের মধ্যে কয়েক ঘর গোয়ালা ব্যতীত বাকি সবাই ছিল নমঃশূদ্র। নমঃশূদ্রদের তিন চারটি পরিবার কামার, ছুতোর ও করাতির কাজ করত। অন্যেরা ছিল কৃষিজীবী। গোয়ালাদের মধ্যে একটি পরিবারের এবং একটি নমঃশূদ্র পরিবারের বহু জমিজমা ছিল। তালুক স্বত্বেও ছিল ওদের অংশ। সুতরাং রাইয়ত প্রজাও ছিল। ব্রাহ্মণরাও তালুকদার ছিল। খাসখামার জমিও ছিল ওদের। ওরা নিজে চাষবাস করত না, খাসখামার জমি নমঃশূদ্র ও মুসলমান চাষি বর্গা করত। অধিকাংশ ব্রাহ্মণ পরিবারের সুদি কারবার ছিল। অনাদায়ি রেহানি ঋণের দায়ে মুসলমান ও নমঃশূদ্র চাষিদের জোতজনি সুদখোর ব্রাহ্মণ পরিবারগুলোর অধিকারে চলে যাচ্ছিল। চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ দেওয়া হতো। তিরিশের দশকে ঋণ সালিশি বোর্ড হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত উক্ত অর্থনীতির বিরুদ্ধে কোনো প্রতিকার ছিল না। মুসলমানদের মধ্যে প্রায় সকলের পেশা ছিল স্বহস্তে জমি চাষ অথবা জনমজুরি। বর্ষার অবসরকালটায় কেউ কেউ পাট ও তরিতরকারির কারবার করত। পাটের মৌসুমে একটি পরিবার বাকরখানি রুটি তৈরি করে ফেরি করত। গৃহস্থ গৃহিণীর পাটের বিনিময়ে বাকরখানি রুটি এবং বেদেনিদের কাছ থেকে রেশমি চুড়ি রাখত।
গ্রামে লেখাপড়ার চর্চা বিশেষ একটা ছিল না। মুসলমানদের মধ্যে একমাত্র আমার পিতাই মোটামুটি শিক্ষিত লোক। তিনি বাংলা ছাড়াও উর্দু ও ফারসি বলতে পারতেন। আমার মা বাংলা বইপত্র পড়তে পারতেন, কিন্তু লিখতে পারতেন না। আমার ফুপুও বাংলা, উর্দু, ফারসি বলতে ও লিখতে পারতেন। মুসলমান সম্প্রদায়ের ব্যকি অধিকাংশই ছিল নিরক্ষর। কেউ কেউ কায়ক্লেশে নাম স্বাক্ষর করতে এবং পুথি পড়তে পারত। সমাজে পুথি পড়ুয়াদের বিশেষ সম্মান ছিল। আমির হামজা, সায়ফুল মূলক ও বদিউজ্জামাল, সোনাভান প্রভৃতি পুথি বিশেষ জনপ্রিয় ছিল। জ্যোৎস্নালোকিত উঠানে বগুনার ওপর কুপি জ্বালিয়ে পুথির মজলিস বসত। বাবা এসব পছন্দ করতেন না। আমাদের বাড়িতে পুথির মজলিস বসতে কখনো দেখিনি। খান, পাট, আখের চাষ হতো গ্রামে। শীতকালে আখ ভাঙাবার গাছ আসত। গ্রামের ছেলেরা আখের গাছের জোয়াল ঠেলত। আমিও ঠেলেছি। এই পরিবেশে কেটেছে আমার বাল্যকাল।
শব্দের অর্থ
আরও দেখুন...